বাড়ির মালিককে ফাঁসাতে পানির ট্যাংকে ফেলে শিশুকে হত্যা

বাড়ির মালিককে ফাঁসাতে চট্রগ্রামে পানির ট্যাংকে ফেলে হাজিগঞ্জের এক শিশুকে হত্যা

স্টাফ রিপোর্টার :
করোনাকালেও থামছে না নৃশংসতা। একের পর এক হচ্ছে খুন। পূর্ব শত্রুতার জের ধরে নিরপরাধ দুই বছরের একটি শিশুকে পানির ট্যাংকে ডুবিয়ে হত্যা করেছে নাজমা বেগম নামে পাষন্ড এক নারী।

গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে সে স্বীকার করেছে ফরিদ নামে এক ব্যক্তির কথায় দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী নুরুল আলম মিয়াকে ফাঁসাতে গিয়ে তার বাড়ির এক ভাড়াটিয়ার শিশু আরাফকে হত্যা করেছে সে।

তার আর্থিক দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে তাকে টাকার লোভ দেখিয়ে দুই বছরের শিশু আরাফকে হত্যা করানো হয়। আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও নাজমা বেগম ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে। গ্রেপ্তার নাজমা কুমিল্লার মুরাদনগর থানার থোল্লা বাখরনগর আউয়াল ভূঁইয়ার বাড়ির তাজুনুর ইসলাম প্রকাশ বাবুলের স্ত্রী। তিনি বাকলিয়া থানাধীন ম্যাচ ফ্যাক্টরি রোডে নুরুল আলম মিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকতেন।

গত ৭ জুন চট্রগ্রামের বাকলিয়া থানাধীন ম্যাচ ফ্যাক্টরি রোডে নুরুল আলম মিয়ার বাড়ির ছাদে পানির ট্যাংক থেকে আবদুর রহমান আরাফের (২) মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আবদুর রহমান আরাফ নুরুল আলম মিয়ার বাড়ির ভাড়াটিয়া আবদুল কাইয়ুমের ছেলে। আবদুল কাইয়ুম চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার ৯নং গন্ধর্ব্যপুর উত্তর ইউনিয়নের তারালিয়া গ্রামের বাসিন্ধা। আবদুল কাইয়ুম ওই বাসার নিচতলায় স্ব-পরিবারে বাসা ভাড়া থাকেন।

এ ঘটনায় ৯ জুন মঙ্গলবার নাজমা বেগমকে গ্রেপ্তার করে বাকলিয়া থানা পুলিশ। বিকেলে অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মহিউদ্দীন মুরাদের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় নাজমা বেগম।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) শাহ মোহম্মদ আবদুর রউফ বলেন, আরাফের পরিবারের কারো সাথে কোন শত্রুতা নেই, শুধুমাত্র তাদের বাড়ির মালিককে ফাঁসাতে খুনী চক্রের ঐ বিল্ডিংয়ের যেকোন একটা শিশুর প্রয়োজন ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে টার্গেট হয় নিরপরাধ আরাফ। আরাফ হত্যার ঘটনায় মূল খুনী নাজমা বেগমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাকে মঙ্গলবার বিকেলে আদালতে পাঠানো হলে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।  তিনি বলেন, হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত আসামিদের বিষয়ে তথ্য পেয়েছি। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নেজাম উদ্দীন বলেন, নাজমা বেগমের ছেলে হাসান নুরুল আলমের বাড়ির দারোয়ান হিসেবে কাজ করেন। হাসানের কাছ থেকে ছাদের চাবি নিয়ে পার্কিংয়ে খেলার সময় শিশুটিকে নিয়ে ছাদে গিয়ে হত্যা করে পানির ট্যাংকে লুকিয়ে রাখে। ঘটনার পর নাজমা বেগম স্বাভাবিক জীবনযাপন করছিলেন। নাজমা বেগম ঋণগ্রস্ত বলে জানিয়েছে আমাদের।

তিনি বলেছেন, ফরিদ নামে এক ব্যক্তির প্ররোচনায় তিনি এ হত্যাকা- ঘটিয়েছেন। ফরিদের সঙ্গে বাড়ির মালিক নুরুল আলম মিয়ার দ্বন্দ্ব রয়েছে। এর জের ধরে নাজমা বেগমকে টাকা দিয়ে তিনি প্ররোচনা দেন।

জবানবন্দীতে আসামী নাজমা বেগম (৪০) জানায়, তিন বছর আগে তার স্বামী তাজুল ইসলাম বাবুল হার্নিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে।  স্বামীকে প্রাইভেট হাসপাতালে অপারেশন করিয়ে সুস্থ করতে প্রায় তিন লক্ষ টাকা সুদের উপর ধার করতে হয়। উক্ত সুদের কিস্তির টাকাসহ পরিশোধ ও সংসার পরিচালনা করতে গিয়ে আসামী নাজমা বেগম দিনে দিনে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তার স্বামীও কোন কাজকর্ম করতে পারে না। তার উপর গত তিন মাস যাবৎ লকডাউন শুরু হলে মেয়েদের গার্মেন্টেসের চাকরিও বন্ধ হয়ে যায়। নাজমা বেগম ধার দেনা করে কাগজের ঠোঙ্গা তৈরি করে কোনরকমে সংসার চালানোর চেষ্টা করে। এলাকায় বিভিন্ন লোকজন তার কাছে নয় লক্ষ টাকা পাওনা আছে।

নাজমা আরো জানায়, এলাকার পূর্ব পরিচিত মো. ফরিদ (২৮), আসামির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কিছুদিন আগে থেকে তার বিল্ডিংয়ের মালিক নুরুল আলম মিয়ার সাথে এলাকার কাউন্সিলর ইয়াছিন চৌধুরী আশুর দ্বন্দ্বের জেরে পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকা- ঘটানো হয়। ফরিদ নাজমাকে বিভিন্নভাবে তাকে বারবার প্ররোচনা দিত। নাজমা যেন তাদের বিল্ডিংয়ের (মিয়ার বিল্ডিং) কোন ছোট ছেলে-মেয়েকে মেরে বিল্ডিংয়ের নবম তলায় পানির ট্যাংকের ভিতর ফেলে রাখে, যাতে এই ঘটনায় বিল্ডিংয়ের মালিক মিয়া ফেঁসে যায় এবং সে যাতে এলাকার কাউন্সিলর হতে না পারে। একদিকে পাওনাদারদের চাপ অন্য দিকে ফরিদের প্রলোভনের একপর্যায়ে ফরিদের কথামত কাজ করতে রাজী হয় নাজমা।

একই বিল্ডিংয়ের ভাড়াটিয়া আব্দুল কাইয়ুমের দুই বছরের শিশু আরাফকে হত্যার পরিকল্পনার বিষয়টি ফরিদকে ২/৩ দিন আগে রাস্তায় দেখা হলে জানায় নাজমা। তখন ফরিদ বলে, তুমি কাজ কর টাকা তোমার জন্য রেডি আছে। আসামি ফরিদের কথামতো ৭ জুন সন্ধ্যা ৬টার দিকে বাইরে থেকে বাসায় আসার পথে তাদের বিল্ডিংয়ের নীচতলায় (পার্কিং) আব্দুল কাইয়ুমের সন্তান আরাফকে পার্কিংয়ে হাঁটতে দেখে। আশপাশে কোন লোকজন না দেখে আদর করার ছলে কোলে নেয়। আরাফকে কোলে নিয়ে বিল্ডিংয়ের ছাদের দিকে যেতে থাকে। নাজমা তার ছেলে হাসানের (বিল্ডিংয়ের দারোয়ান) কাছে থাকা চাবি দিয়ে ছাদের দরজার তালা খুলে দেয়। আরাফকে নিয়ে অষ্টম তলার উপর সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে শিশু আরাফকে পানির ট্যাংকের ভিতর ফেলে দেয়। আসামি যখন আরাফকে নিয়ে পানির ট্যাংকের উপর উঠে পার্শ্ববর্তী বিল্ডিংয়ের ছাদের উপর হইতে নাজিম উদ্দিন ও আলিম উদ্দিনের স্ত্রীরাসহ অন্যরা তাকে দেখে। কিন্তু আসামি সেই দিকে কোন খেয়াল না করে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক তার কোলে থাকা আরাফকে ট্যাংকের মুখ দিয়ে ভিতর ফেলে দেয়। ফেলে দেওয়ার পর আসামি তার বাসায় চলে আসে।

খুন হওয়া আরাফের পিতা ও মামলার বাদী মো. আব্দুল কাইয়ুম (৩৮) অপসোনিন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডে চাকরি করেন। ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি জানান, অন্যান্য দিনের ন্যায় ৭ জুন বিকাল বেলা অফিসিয়াল কাজে তিনি কেসিদে রোডে যান। বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে মোবাইল ফোনে তার স্ত্রী তাকে জানায় যে, আরাফকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সংবাদ পাওয়া মাত্রই তিনি মোটর সাইকেলে দ্রুত বাসায় আসেন। বাসায় আসার পর তার স্ত্রী জানায়, ছেলে আরাফ বিকাল ৫টার পর বাসার সামনে খেলতে বের হয়।  বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরও ছেলে বাসায় ফিরে না আসলে তার স্ত্রী বাসা থেকে বের হয়ে তাকে দেখতে না পেয়ে তাকে ফোন দেয়। আবদুল কাইয়ূম আশেপাশে এবং মহল্লায় সব অলি-গলিতে ছেলেকে খোঁজ করেন।  স্থানীয় মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে এবং এলাকায় মাইকিং করে ছেলেকে খোঁজার ব্যবস্থা করেন। কোথাও ছেলেকে না পেয়ে বাকলিয়া থানায় এসে একটি নিখোঁজ ডায়রি (নং ২৪৮) করেন।

তিনি আরো বলেন, রাত সাড়ে আটটার দিকে স্থানীয় মো. হেলাল মোবাইল ফোনে তাকে জানায় যে, আরাফকে তার ভাড়া বাসার বিল্ডিংয়ের ছাদে অর্থাৎ বাকলিয়া থানাধীন হাজী মনসুর আলী রোড ম্যাচ ফ্যাক্টরি মিয়াখান নগর মিয়ার বিল্ডিংয়ের ছাদে পানির ট্যাংকে পাওয়া গেছে।  সংবাদ পেয়ে তিনি দ্রুত ঘটনাস্থলে যান। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন স্থানীয় লোকজন তার ছেলে আরাফকে পানির ট্যাংক থেকে তুলে মৃত অবস্থায় ছাদে শুইয়ে রেখেছে। সংবাদ পেয়ে তৎক্ষণাৎ পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে এবং স্থানীয় লোকের সহায়তায় আরাফকে চমেক হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত ডাক্তার তার ছেলেকে পরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করেন এবং লাশ মর্গে প্রেরণের ব্যবস্থা করেন।

Recommended For You

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *